ভুল বোঝাবুঝি
দুটো রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি, হসপিটালের কাজ মিটিয়ে, শ্মশানের কাজ শেষ করে যখন বাড়ি আসছি, প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠতেই পাশ থেকে বোন রিমা বলল, দাদা তোমার ফোনটা বাজছে। ফোনটা কানের কাছে নিয়ে ওকে করতেই ও প্রান্ত থেকে শাশুড়ি মা বললেন তোমাদের মেয়ে হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম অঞ্জলি কেমন আছে ? শাশুড়ি মা বললেন, মা মেয়ে দু'জনেই ভালো আছে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম কোন হসপিটালে আছে ? শাশুড়ি মা বললেন প্যারাডাইস নার্সিংহোমে আছে বলে ফোনটা কেটে দিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বোন রিমা জিজ্ঞাসা করল দাদা, বৌদির কি হয়েছে ? আমি বললাম আমি মেয়ের বাবা হয়েছি ! তুই এক কাজ কর, বাড়িতে গিয়ে স্নান করে ফ্রেস হয়ে আমার সঙ্গে চল। আমি মোটরসাইকেলটা বার করছি, দু'জনে একসঙ্গে গিয়ে দেখে আসি। রিমা বলল না দাদা তুমি যাও, আমাদের নিয়েই তো অনেক ঘটনা ঘটলো, আমাকে দেখলে বৌদি হয়তো রাগ করবেন, তার থেকে তুমি একা যাও। আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম, যা বলছি তাই কর, রেডি হয়েনে। বোন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর ঘরের দিকে গেল রেডি হতে।
আমি দেখলাম রিমার চোখ মুখ ফুলে গেছে কান্নাকাটি করার জন্য। আমি সে দিক থেকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে গ্যারেজের দিকে এগোতে লাগলাম মোটরসাইকেলটা বার করতে।
আমি আর রিমা যখন নার্সিংহোমে পৌছালাম তখন ঠিক ছটা বাজে। কেবিনের বাইরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম অঞ্জলি বেডে শুয়ে আছে ওর বাবা বেডের পাশে একটা চেয়ারে বসে আছেন, মা আর বউদি আমাদের বাচ্চাটাকে আদর করছে। হঠাৎ অঞ্জলির দৃষ্টি আমার দিকে পড়তেই, জিজ্ঞাসা করলাম ভিতরে আসতে পারি ? জবাবে অঞ্জলি কিছু না বলে অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। আমার কথা শুনে কেবিনের ভিতরে থাকা সবার চোখ আমাদের দিকে ঘুরে এলো। সবাইয়ের দৃষ্টিটা কেমন যেন অস্বস্তিকর, আমাকে দেখার আগে সবাই হাসছিল কথা বলছিল। কিন্তু আমাকে দেখামাত্রই সব আনন্দ হাসি যেন উড়ে গেল। এমন একটা ভাব আমি যেন অযাচিত। আমি আর কিছু না ভেবে রিমাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে বেডের কাছে এসে অঞ্জলিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছো ? অঞ্জলি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল সেটা জেনে তোমার কি লাভ ? আর এখানে তোমাকে কে আসতে বলেছে ? অভিমান আর রাগের সুরে অঞ্জলি কথাগুলো বলল। অঞ্জলির বাবা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা কথা বলো আমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। বলে তিনি কেবিনের বাইরে চলে গেলেন। এক এক করে ঘরে যারা ছিল সবাই বাইরে চলে গেল। আমি অঞ্জলির কথায় কিছু মনে না করে ওর বাবার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটায় বসলাম। রিমা বাচ্চাটাকে দেখছিল। হঠাৎ ঘরের পরিবেশটা দেখে সেও বাইরে চলে গেল।
অঞ্জলি এবার আমার দিকে ফিরে বলল তোমাকে তো দেখছি মা আর মেয়ে মিলে ভালোই বশ করেছে। আমি দু'দিন ধরে নার্সিংহোমে পড়ে আছি সেটার কোনো খোঁজ নেওয়ার সময় তুমি পাওনি ? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম তোমার মেয়েটার কথা ভেবে তো আসতে পারতে, তাই না ? আমি সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে আমার বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে অঞ্জলীর পাশে বসে বললাম, মেয়েটা কিন্তু একদম তোমার মতো দেখতে হয়েছে। অঞ্জলি একটু গম্ভীর হয়ে বলল হ্যাঁ এই কথাটা সবাই বলছে। একটু চুপ করে থেকে অঞ্জলি বলল তুমি আমার কথাটা এড়িয়ে গেলে কেন ? আমি বললাম, কোন কথা ? সে বলল, আজ দু'দিন ধরে আমি নাসিংহোমে আছি, কেন তুমি একটি বারের জন্য আমাদের মা মেয়েকে দেখতে আসোনি ? আমি বললাম, একটু দৌড়াদৌড়ি আর ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম, তাই সুযোগ করে উঠতে পারিনি। তুমি ব্যস্ততা দেখাচ্ছ, তাও আমাকে ? অঞ্জলি একটু রেগে গিয়ে বলল। কি এমন ব্যস্ততা ছিল তোমার ? গত এক সপ্তাহ ধরে রিমার মাকে নিয়ে হাসপাতলে ছিলাম। আমিও তো গত দু'দিন ধরে এখানে আছি, প্রথম দিকটায় তুমি তো আসতে পারতে ? হ্যাঁ তা পারতাম, তবে, গত দু'দিন ধরে রিমার মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আর...
ভালোই বশ করে নিয়েছে তোমাকে, তাই আমাকে এত অজুহাত দেখাচ্ছ। আমার কথা শেষ করার আগেই আমার কথার মধ্যেই একটু রেগে উঠে কথাটা বলে অঞ্জলি। আমি কিছু না বলে শুধু অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অঞ্জলি আরো রেগে গিয়ে বলল, কি হলো, তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন ? আমি একটু আস্তে করে বললাম, তোমার কাছে তো আমার কথার কোন দাম নেই। আমার কথা তো তুমি শেষ করতেই দিচ্ছ না। হ্যাঁ ঠিক আছে ঠিক আছে বল, ওদেরকে নিয়ে তোমার আর কি বা বলার আছে। গতকাল রাত্রে রিমার মা মারা গেছেন। কথাটা শোনার জন্য মনে হয় অঞ্জলি প্রস্তুত ছিল না। তাই কথাটা শুনেই অঞ্জলি মনে হলো একটু শক খেয়ে চুপ করে গেল। আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছো তো ? আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে উল্টে আমার দিকে তাকালো। আমি আবার বললাম, কি হল তুমি বলছো না যে ? তুমি কি এখনো কিছু খাওনি ? অঞ্জলি বলল হ্যাঁ আমি খেয়েছি কিন্তু তোমার চোখ মুখ এরকম শুকনো দেখাচ্ছে কেন ? তুমি কি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছ না ? আমি বললাম, আসলে গতকাল থেকে রিমার মাকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম একদম খাওয়া-দাওয়া করার সময় পাইনি। অঞ্জলি আর কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে চুপ করে গেল। আমি কথা না বাড়িয়ে মেয়েটাকে শুইয়ে দিলাম বিছানায়।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার বোধ হয় এখানে বেশী সময় ধরে থাকাটা ঠিক হবে না। অঞ্জলি বলল, কেন ? আমি বললাম, তোমরা তো চাও না আমি এখানে বেশী সময় থাকি, তাই না ? অঞ্জলি কোন উত্তর দিতে পারল না। আমি বললাম ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো আর আমার মেয়েটারও খেয়াল রেখ। অঞ্জলি চুপ করে থাকলো। আর কদিন থাকতে হবে এখানে ? এবার অঞ্জলি বলল, জানিনা। আচ্ছা, তাহলে এখন আসি আমি। পরে আবার সময় করে আসবো বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, আমি বের হতেই, তারা আবার কেবিনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমার সঙ্গে কোন কথা বলার প্রয়োজন বোধ তারা করলো না। বাইরে বেরিয়ে আসতেই রিমা বলল, দাদা তুমি চাইলে তো আরও কিছু সময় থাকতে পারতে ! আমি বললাম হ্যাঁ তা পারতাম, কিন্তু তুই তো দেখলি, সেটা তো কেউ চাইনি। তুই নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছিস এরা প্রত্যেকেই কিভাবে আমাকে এড়িয়ে গেল। কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলল না। রিমা আবার বলল, তাহলে এখন কি করবে ? কি আর করব, চল বাড়ির দিকে যাই। নিচে এসে মোটরসাইকেল স্টার্ট করবার আগে রীমাকে বললাম, এখন অনেক রাত হয়ে গেছে, বাড়িতে গিয়ে রান্নার ঝামেলা করে লাভ নেই, তার থেকে কোন রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে সোজা বাড়ি চলে যাব।
বাড়িতে ঢুকে রিমা বলল, জানো দাদা, আসলে বৌদি আমার আর মায়ের জন্যই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমি রীমাকে বললাম, ঠিক তা না রে, আসলে অঞ্জলি হচ্ছে খুব অভিমানী ! ওর জেদ আর রাগ কমলে আবার ঠিক চলে আসবে, ও নিয়ে তুই চিন্তা করিস না, যা গিয়ে শুয়ে পড়। রিমা আর কোন কথা না বাড়িয়ে ওর ঘরে চলে গেল। আমিও আমাদের মানে অঞ্জলির ঘরে চলে আসলাম। ঘরটা ভীষণ খালি খালি লাগছে। আজ প্রায় এক মাসের মতো এই ঘরটায় আমাকে একা একা থাকতে হয়। সারা শরীরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে, আমি জানি এখন আমি শুলেও আমার ঠিক ঘুমও আসবে না। তাই জামা-প্যান্ট চেঞ্জ করে ভালো করে স্নান করে বারান্দায় এসে বসলাম। দূরে অন্ধকারের মধ্যে কয়েকটা জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে সেই দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম......
কলিং বেল বাজানোর কিছু সময় পরে, দরজা খুলে অঞ্জলি আমার পাশে রিমা আর মাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, এনাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না ? আমি বলেছিলাম, আরে আমাদের আগে ভিতরে আসতে দাও তারপরে সব বলছি। কথাটা বলার পর অঞ্জলি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়, আমরা ভিতরে প্রবেশ করি। আমি রিমাদের একটা ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে বললাম, আজ থেকে তুই আর মা এই ঘরেই থাকবি। কথাটা বলার পর অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে যেন কেমন চোখে তাকালো আমার দিকে, তারপর হন হন করে নিজের ঘরে চলে গেল। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রিমা আর মাকে ঘরের সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এলাম। ঘরে ঢুকতেই অঞ্জলি বলল, কে ওরা ? আর আমাদের বাড়িতে কেন ? আমি বললাম আমার মা আর বোন, আজ থেকে ওরা এই বাড়ীতেই থাকবে। তোমার মা আর বোন ? কই আগে তো কখনো শুনিনি ! তুমি তো বলেছিলে তোমার কেউ নেই, তাহলে হঠাৎ করে মা আর বোন এলো কোথা থেকে ? বা, আমার কেউ নেই বলে এরা আমার মা আর বোন হতে পারে না ?? অঞ্জলি খুব রেগে গিয়ে বলল, না হতে পারে না। রাস্তা থেকে কাউকে ধরে নিয়ে এসে মা আর বোন বানিয়ে এখানে রাখা যাবে না। আমি বলেছিলাম, কি বলছো তুমি ! রাস্তা থেকে তুলে এনে মানে ? অঞ্জলি সেই একই সুরে বলেছিল, মানেটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝে গেছো। আমি একটু রেগে গিয়ে বলেছিলাম, দেখো অঞ্জলি আমি কিন্তু ওনাদের রাস্তা থেকে তুলে আনিনি। আর ওরা আমার নিজের মা-বোন না হলেও আমার রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি কিছু হয়। অঞ্জলি একটু ক্রিটিসাইজ করে বলেছিল, কি রকম ? আমি অঞ্জলীর ভাব দেখে বললাম, সেটা এখন বলা যাবেনা, পরে বলব। এখন আমি খুব ক্লান্ত, তুমি প্লিজ একটু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করো। অঞ্জলি দাম্ভিক হয়ে বলল, সেটা করা যাবে না। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, কেন করা যাবে না ? সে আবার বলেছিল, ওই মেয়ে আর ওই মহিলা এই বাড়িতে থাকতে পারবে না। আমিও বলেছিলাম, ওরা এই বাড়িতেই থাকবে। সে বলেছিল, না থাকতে পারবে না। আমি ; কেন ? সে ; আমি সেটা চাইনা তাই। আমি; তুমি যা চাইবে তাই হবে নাকি ? সে; হ্যাঁ তাই হবে। আমি বলছি ওরা এই বাড়িতেই থাকবে। সে; তাহলে আমি এই বাড়িতে থাকব না। আমি রাগের মাথায় বলে ফেললাম, সেটা তোমার ব্যাপার, তুমি না থাকলে আমার কিছু করার নেই। কি বললে তুমি ? আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। ওরা তোমার কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ওদের কারণে তুমি আমাকে চলে যেতে বললে ! ঠিক আছে, যতদিন ওই মহিলা আর মেয়েটা এই বাড়িতে থাকবে ততদিন আমি এই বাড়িতে থাকব না। আমি তখন অঞ্জলিকে বোঝাবার চেষ্টা করি, সে আমার কোন কথায় কান না দিয়ে তার বাবাকে ফোন করে আসতে বলল। আমি অবশ্য অঞ্জলিকে জোর করে আটকানোর চেষ্টা করিনি, কারণ সে পেগনেন্ট ছিল। জোরাজুরি করতে গিয়ে শেষে যদি কিছু হয়ে যায় ! এই ভয়েতে। আমি নানা রকম ভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে কোন কথাই শুনতে রাজি নয়। আমি আর কিছু না বলে বারান্দায় চলে এসেছিলাম। সে তখন কাপড় চোপড় গোছাতে লাগলো। খানিক পরে অঞ্জলির বাবা চলে এলেন, আমার সঙ্গে কোনো কথা বার্তা না বলেই মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন।
এই একমাস আমি অঞ্জলিদের বাড়িতে গিয়ে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করেছি, বাড়িতে ফেরত আসার জন্য অনেক বলেছি কিন্তু আমার কোন কথাই সে শুনে নি। বরং যা তা বলে আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
বুকের ভিতরটায় কষ্ট হতে লাগলো আর বসে না থেকে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। অঞ্জলি আর আমাদের মেয়েটার কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি। একটু বেলা করে ঘুম ভাংতে দেখি, বাইরের মেইন দরজাটা খোলা। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি রিমা শিউলি ফুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ডিস্টার্ব না করে আমি ফ্রেস রুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ রুম থেকে বেরিয়ে দেখি রিমা রান্নাঘরে চা করছে। আমি ঘরে এসে বসতেই রিমা চা দিয়ে বলে গেল টিফিনটা এক্ষুনি হয়ে যাবে বাইরে বের হবার আগে টিফিনটা খেয়ে যাবে। আমি বললাম তাহলে একটু তাড়াতাড়ি দে, হসপিটালে যেতে হবে, দেখি তোর বৌদির জেদ আর অভিমান ভাঙাতে পারি কিনা। তুই কি যাবি আমার সঙ্গে ! না দাদা আমি যাবনা, ঠিকই বলেছ, তুমি যাও। আমি বরং বাড়িতে থেকে দুপুরের রান্নাটা করে রাখি।
হসপিটালে যখন পৌছালাম তখন সকাল নটা বাজে। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে অঞ্জলি বসে আছে, ওর মা পাশে বসে ফল কাটছে। কেবিনে ঢুকতেই শাশুড়ি মা আমায় দেখে বললেন কখন এসেছ বাবা। আমি বললাম এইতো আসছি। অঞ্জলি বলল তুমি আজ অফিসে যাওনি ? আমি বললাম না, ছুটি নিয়েছি। শাশুড়ি মা বললেন সেই মেয়েটাকে নিয়ে আসোনি ! আমি বললাম, আসতে বলেছিলাম কিন্তু ও আসতে চাইনি, একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম। অঞ্জলি বলল, সকালে টিফিন করেছ। আমি বললাম হ্যাঁ, তোমরা করেছো ! অঞ্জলি বলল, হ্যাঁ, আমাদের টিফিন হয়ে গেছে বলে সে চুপ করে গেল। শাশুড়ি মা ফল কাটতে লাগলেন। আমি অঞ্জলিকে বললাম বাচ্চাটাকে একটু দাওতো কোলে নেই। মেয়েটাকে আদর করতে করতে অঞ্জলীকে বললাম, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। অঞ্জলি বলল হ্যাঁ বল, আমি বললাম, কথাগুলো বলার আগে ছোট একটা গল্প বলতে চাই, তুমি শুনবে ? অঞ্জলি মাথা নেড়ে সায় দিল, শাশুড়ি মা আমি কি কথা বলছি সেই দিকে কান রেখে ফল কাটতে লাগলেন। আমি বলতে লাগলাম.......
ছেলেটা অনাথ ছিল। একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ হচ্ছিল। যে অনাথ আশ্রমে ছেলেটা থাকতো তার পাশে একটা বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে একজন মহিলা তার স্বামীকে নিয়ে থাকতেন। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। সেই সুবাদে অনাথ আশ্রমের ছেলেটা যখন যখন তাদের বাড়ির আশেপাশে খেলা করতো, তখন সেই ভদ্রমহিলা ছেলেটাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে ফলমূল এটা ওটা সেটা তাকে খাওয়াতো। একদিন সেই ভদ্রমহিলা জানতে পারলেন সেই ছেলেটার বাবা-মা কেউ নেই। তখন সেই ভদ্রমহিলা অনাথ আশ্রমের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্ত কাগজপত্র যা যা ফরমালিটিজ সেগুলো মেইনটেইন করে, ছেলেটিকে ওরা গ্রহণ করে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করতে লাগলেন। কথাগুলো বলে একটু দম নিয়ে নিলাম, অঞ্জলি অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, তারপর ? ছেলেটিকে ওনারা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। ছেলেটিও তাদের মা-বাবা বলেই ডাকতো, ছেলেটি যখন সপ্তম শ্রেণীতে উঠলো তখন তাদের একটি মেয়ে হল। নিজেদের সন্তান হওয়ার পরও, ছেলেটির প্রতি ভালোবাসা বিন্দুমাত্র তাদের কমেনি। সবকিছু মানিয়ে নিয়ে তারা খুব ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ভদ্রলোক মারা যাওয়াতে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। ছেলেটা সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। ভদ্রমহিলা ছেলেটিকে বলেন তুমি এবার তোমার নিজের জীবন নিজে কি করে গড়বে সেটা তুমি নিজে ঠিক করো। ছেলেটা সেদিন সেই ভদ্রমহিলাকে কিছু বলতে পারিনি, কারণ সে নিজেই দেখছিল সংসার ঠিকমত চলছে না। ভদ্রমহিলা ছেলেটিকে কিছু টাকা হাতে দিয়ে দেয়, ছেলেটি শহরে চলে আসে। একটি সৎসঙ্গ মন্দিরে থেকে তাদের যোগাযোগে কলেজে কোন রকমে ভর্তি হয়। কিছু টিউশনিও জোগাড় হয়ে যায়। খেয়ে না খেয়ে পড়ার খরচ চালিয়ে মাঝে মাঝে বোনটার জন্য টাকা পাঠানোর মাধ্যমে নিজের জীবন গড়তে শুরু করে। একদমে কথাগুলো বলে থামলাম। শাশুড়ি মা মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনছিলেন, কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখটা মুছতে দেখলাম। অঞ্জলি চুপ করে আছে, শাশুড়ি মা কাটা ফলের প্লেটটা আমার সামনে দিয়ে উনি বললেন, তারপর, আবার বলতে শুরু করলাম.....
তারপর এক সময় ছেলেটা লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটা চাকরি পায়, পরে বিয়েও করে। তবে এসবের মাঝেও ছেলেটি ওই মহিলা আর ছোট বোনটাকে ভুলে যায়নি। শহরে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিল সে, কিন্তু কোনক্রমেই তারা রাজি হয়নি। তবে ছেলেটি ওদের জন্য সময়মতো টাকা পাঠাত, সেই বিষয়টা ছেলেটি তার বউ আর শ্বশুর বাড়ির সকলের কাছে গোপন রেখেছিল। একদিন ছেলেটিকে ওর বোন ফোন করে বলে, মায়ের নাকি নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তখন ছেলেটি তাদের ডাক্তার দেখানোর জন্য শহরে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। যদিও মহিলাটি আসতে চাইছিল না, কিন্তু ছেলেটির জোরের কাছে হার মেনে তাদের আসতে হয়। বিপত্তি ঘটে তখনই যখন ছেলেটি ওদেরকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে, ছেলেটির বউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটির উপর রাগ করে প্রেগনেন্সি অবস্থাতে ছেলেটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে চলে যায়।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পিছনে ঘুরতেই দেখি শ্বশুরমশাই শালাবাবু আর শালা বাবুর বউ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমার একটু অস্বস্তি হতে লাগলো, তাই বসে না থেকে আমার মেয়েটাকে অঞ্জলির কোলে দিতে গিয়ে দেখলাম তার চোখের কোনটা চিকচিক করছে। আমার মনে হল সে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছেনা। আমি বললাম রিমা বাড়িতে একা আছে, আমায় বাড়ি যেতে হবে। কেউ কিছু বলছে না দেখে আমি কেবিন থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম। বাড়িতে আসতেই রিমা বলল, দাদা তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে ! বৌদি আসবে নাকি ? জানিনা হয়ত আসতেও পারে নাও পারে। দাদা তুমি আমাকে গ্রামে দিয়ে এসো না। থাপ্পড় চিনিস থাপ্পড় ? তুই এখানেই থাকবি, তুই না আমার ছোট বোন। তোর রান্না কতদূর, খিদে লেগেছে তো। রিমা বলল তুমি ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নাও তার মধ্যে আমার রান্না হয়ে যাবে।
বিছানায় শুয়ে অনেক কথা মনে করতে করতে ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। আড়ামোড়া দিয়ে যেই ঘুরতে গেছি দেখি বাচ্চাটা আমার পাশেই শুয়ে আছে, ভালো করে তাকিয়ে দেখি এ তো আমারই বাচ্চা ! এইখানে কি করে ? তাহলে কি ? হঠাৎ পাশের ঘর থেকে অনেকের কথা-বাত্রা, হাসা-হাসির আওয়াজ কানে আসলো। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের দিকে আসতেই দেখি, আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, শালাবাবু তার বউ, অঞ্জলি আর রিমা সবাই বসে গল্প করছে। আমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম আপনারা কখন এসেছেন আমাকে ডাকেননি কেন ? অঞ্জলি বলল, তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে তোমাকে আর ডাকিনি। বাচ্চাটা আমার কাছে দাও, অনেক বেলা হয়ে গেছে, চলো সবাই একসঙ্গে বসে খেয়ে নেই।
Comments
Post a Comment