চিরায়ত
আজ পৌষ সংক্রান্তি।কাবেরী র মনে পড়ছিল ছেলেবেলার সেই দিনগুলির কথা।গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু একান্নবর্তী পরিবারের একমাত্র মেয়ে সে।মাথার উপরে দাদু,ঠাম্মা,জ্যেঠু,বড়মা,বাবা,মা,কাকুমণি,কাকিমনি,আর জ্যেঠতুতো,খুড়তুতো,নিজের মিলিয়ে চারজন দাদা।তাদের ছিল নিজস্ব ধানিজমি।তাতে সারাবছর হাসি ফোটাত সোনার ফসল।
কাবেরীদের গ্রামের প্রতিটি কৃষক পরিবারে পৌষসংক্রান্তিতে পালিত হত আউনি বাউনি।এই অঞ্চলের প্রধান ফসল হেমন্তে আমন ধান প্রথম ঘরে তোলার প্রতীক হিসেবে পাকাধানের কয়েকটি শীষ ঘরে তুলে পালন করা হয় এই আচার।সংক্রান্তির আগেরদিন সব ঘরবাড়ি,রান্নাঘর,উঠোন ঝকঝকে করে পরিষ্কার করে রাখা হবে ঠাকুমা আশাকুসুম দেবীর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে।পরেরদিন ভোর ভোর বাড়ির সব্বাইকে উঠে পড়তে হবে।কাবেরী ঘুম থেকে উঠে উঠোনে এসেই দেখতে পেত ঠাকুমা আশাকুসুমদেবী আর মা জ্যেঠিমাদের স্নান সারা। পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি,একমাথা ভিজে চুল পিঠময় ছড়িয়ে মা বসেছেন উঠোনে আলপনা দিতে।চালের পিটুলি ঘন করে জলে গুলে মধ্যমা,অনামিকা এবং বৃদ্ধাঙ্গুলির ফাঁকে ঐ তরল বস্তুটিকে নিয়ে কি অপূর্ব দক্ষতায় মা আলপনা দেয়,সারা গ্রামের কেউ আর এমনটি পারেনা।কাবেরী সেইদিকে বিভোর হয়ে তাকিয়ে সব ভুলে যেত।চমক ভাঙতো মায়ের হাঁকে, তখন চট করে মালতি মাসির টিপে দেওয়া টিউবওয়েলের ধোঁযা ওঠা জলে স্নান সেরে তুলে রাখা নতুন জামা পড়ে নিত।এইদিন বাড়ির ছোটদের জন্য বরাদ্দ রেশমের নতুন জামা।শীতেরএই একটি সকালে বাড়ির ছোটরা ঘুম থেকে উঠে স্নান করে তৈরি হতে একটুও বিরক্ত হয় না।বাড়ির পুরুষ মানুষেরাও চা চা করেন না।আজ রান্নাঘর শুধু পিঠেময়-যেখানে ঠাকুমা আর বড়মায়ের একচেটিয়া খবরদারি।কাকিমনি ধানের দুই তিনটে শীষ একসঙ্গে করে পাকিয়ে তার সাথে ধানের শীষ,মূলা ফুল,সরষে ফুল,আমপাতা গেঁথে আউনি বাউনি তৈরি করে বাক্স ,আলমারি,তোরঙ্গ,ঢেঁকি আর ধানের গোলায় গুঁজে দিতে ব্যস্ত।রান্নাঘরে প্রথমে তৈরি হবে আসকে পিঠে।এসবই হয় ঘরের ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়ে।অপূর্ব দক্ষতায় ঠাম্মা আর বড়মার হাতে গড়ে ওঠা এই পিঠে দেখতে কাবেরীর খুব ভালো লাগে।ঠাম্মা তো আবার একটা ছাড়াও শোনান এই সময়-"উলি লো উলি ,নরম জ্বালে আসকে পিঠে ,খর জ্বালে পুলি।"এরপর তৈরি হবে আরও কতরকমের পিঠে-মুগপুলি,পাটিসাপটা,দুধপুলি,নোনতা পিঠে আরো কত।আসকে পিঠে হয়ে গেলে আগে বাড়ির চারকোনা তে চারটে পিঠে দিয়ে আসতে হবে,তারপর খাওয়া।মা লক্ষীর উদ্দেশ্যে একটা পিতলের ঘড়ায় হেমন্তের চাল দিয়ে বসিয়ে চারদিকে আল্পনা দিয়ে আউনি বাউনি দিয়ে,পিঠে সাজিয়ে দেন ঠাম্মা।মায়েরা সবাই ঠাকুরের কাছে বসে সম্বতসরের
সুখ সমৃদ্ধি কামনা করে।তবে কাবেরীর এইদিন অন্যতম আকর্ষণ সামনের বিশাল মাঠ।বেলা বাড়লে ওখানে দলে দলে হাজির ছোট,বড়ো ছেলে মেয়ের দল।এই সংক্রান্তিতে তাদের গ্রামে চলে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা।আগের দিন সারাদিন ধরে বাড়ির ছাদে চলেছে তার প্রস্তুতি।কাবেরী র কাকুমনিকে কেউ হারাতে পারেনা,আর এখন তার সঙ্গত ধরছে জ্যেঠুর ছেলে -কাবেরীর বড়দা।মাঠের ধারে চেয়ারে বসে তদারকি করেন গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা।সে এক হৈ হৈ কান্ড,রৈ রৈ ব্যাপার।সন্ধ্যেবেলা তাদের বাড়ির তুলসিতলায় জ্বলে ওঠে প্রদীপ,আসেন নবীন বোষ্টম তার দলবল নিয়ে।গানবাজনা আসর বসে সেখানে।গ্রামের আর পাঁচজন পুরুষমানুষ আসেন,আর মহিলারা বসেন অন্দরে।সুখদুখের গল্প হয়,গান শোনা হয়,আর হয় পিঠেপুলি খাওয়া।কাবেরী এই সময় বড়মার কাছ ঘেঁষে তাঁর পশমের চাদরের ওমে সেঁকে নেয় নিজেকে।তারপর রাত গড়াবার আগেই বাড়ির ছোটদের পিঠে খাবার পাট শেষ করে যে যার ঘরে।মায়ের বিছানায় লেপ ঢাকা দেওয়াই থাকত ,শুধু তার তলায় লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ার অপেক্ষা।আঃ,পৃথিবীর সব সুখটুকু তখন ওই সুখী গৃহকোনে।
"কিগো মাসিমা বলি কি ভাবছেন গো তখন থেকে,এদিকে আমাকে যে বললেন চাল বেটে দিতে পিঠে করবেন বলে"-কাজের মেয়ে সীমার গলার আওয়াজে হুঁশ ফেরে কাবেরীর।আগের কথা ভাবতে ভাবতে সত্যিই অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে।সেই ছোট্ট কাবেরী আজ সত্তরোর্ধ মিসেস কাবেরী সান্যাল।তাঁর বিয়ে হয়েছিল শহরের নামী উকিল মনোতোষ সান্যালের সঙ্গে।একলার সংসার দেখে আদরের মেয়েকে এই ঘরেই বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা।এ সংসারে ভুলত্রুটি ধরার কেউ ছিলনা,স্বামী ছিলেন কাজপাগল খুব ভালো মানুষ।কাবেরীর বাপের বাড়ির সবাই খুব খেয়াল রাখতেন ।কাবেরী এই বাড়িতে এসে ছোটবেলায় দেখা,শেখা সব আচার,নিয়মগুলো খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে চেষ্টা করত।তারপর চলে গেছে অনেকগুলি বছর।স্বামীও চলে গেছেন প্রায় পাঁচ বছর।আগের বছর একমাত্র ছেলেও চলে গেল বউ ,মেয়ে নিয়ে বিদেশ।আজ এই পৌষসংক্রান্তিতে তিনি একা।উঠে কুলুঙ্গি থেকে সীমার সাহায্যে বার করলেন চাল ভর্তি কুনকে।মাটিতে জলচৌকি বসিয়ে তাতে রেখে চারধারে কাঁপা হাতে আলপনা দিলেন।নিয়মরক্ষা করতে হবেতো।তাতেই মুগ্ধ সীমা-"ওমা মাসীমা,কি সুন্দর আলপনা দিলেন"।"তাও তো তুমি আমার মায়ের হাতের আলপনা দেওয়া দেখোনি,সারা গ্রামে কেউ অমন দিতে পারতনা।"সবকিছু তাঁর হাতের সামনে গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল সীমা।আর তিনি বসলেন আসকে পিঠে গড়তে।হাতের দক্ষতায় ফুলে উঠল পিঠে।প্রথমে এই পিঠে,তারপর একে একে দুধপুলি,পাটিসাপটা, ব্যস, আর একটু সরু চাকলি,গুড়ের পায়েস।আর পারেন না।বয়স হয়েছে,লোকবলের অভাব।এই করে ঠাকুরের সামনে ধরে দিতে দিতেই বেলা গড়ায়।তারপর একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে চোখ জড়িয়ে আসে।ঘুম ভাঙে বেলের আওয়াজে।দরজা খুলে দেখেন একগাল হাসি নিয়ে ছেলে মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে সীমা পরনে তাঁর দেওয়া লাল ছাপার শাড়ি।"ওমা কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে তোদের,আয় আয়।"বলে দোর থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি।ওরা ঘরে ঢুকতে যত্ন করে আসন পেতে বসালেন বাচ্চাদের।সীমার সংকোচ দেখে হেসে বললেন-"ওরে আজ তো তোরা আমার ঘরে নিমন্ত্রিত।তোদেরকে যে যত্ন করে বসিয়ে খাওয়াব,এইতো রীতি।"ছেলে মেয়েরা তো এতো পিঠে দেখে খুব খুশি,সীমার চোখে জল।কাবেরী ওরফে মিসেস সান্যাল ও আজ এদের মধ্যে দিয়েই খুঁজে পেতে চাইলেন ছেলেবেলার সেই পৌষপার্বনের সুখের ওমটুকু।এইভাবেই বয়ে চলে ঐতিহ্যের ধারা
Comments
Post a Comment